একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে লিমা (ছদ্মনাম)। তার মা তাকে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিল। সেই মাদ্রাসায় লিমা একাধিকবার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। লিমার বাবা যখন তার মাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে, তখনো লিমা ঐ মাদ্রাসাতেই পড়াশোনা করত। কিন্তু যখন লিমার মা আবার বিয়ে করে, তখন আক্ষরিক অর্থে শিশুটির কপাল পোড়ে। বিয়ের কিছু দিন পর লিমার সৎ বাবা আর তার দায়িত্ব নিতে চায় না।
পরে মামার বাড়ি খালার বাড়ি করে লিমার জায়গা হয় পথে। মতিঝিল-কমলাপুর ঘুরে কখনো ভিক্ষা করে, কখনো চকলেট বিক্রি করে জীবন চলে। ঘুমানো বা বিশ্রাম নেওয়ার তার নিরাপদ জায়গা নেই। কমলাপুর, রেল স্টেশনে রাতে ঘুমালে প্রতিদিনই তাকে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হতো।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশাল ডেভেলপমেন্ট-(এএসডি)র সার্ভে মতে, পথে বসবাস করা অধিকাংশ বা প্রায় সব মেয়ে শিশুই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এই পরিস্থিতিতে শিশুর সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজ ২ অক্টোবর বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় পথশিশু দিবস। বাংলাদেশে বর্তমানে পথশিশুর সংখ্যার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা বলেন, পথশিশু পুনর্বাসনে পরিসংখ্যান করে রাষ্ট্রের বড় প্রকল্প গ্রহণ প্রয়োজন।
শিশুরা যা বলে: হাইকোটের গেটের সামনে বসে আছে কয়েকটি শিশু, তাদের একজন রিমা। সে হাইকোর্ট এলাকাতেই থাকে। কীভাবে এখানে এসেছে? জানতে চাইলে জানায়, তার এক নানি ঢাকার একটি বাড়িতে তাকে কাজের জন্য দেয়। গৃহকর্ত্রী তাকে প্রতিদিন মারত, তাই সে পালিয়ে আসে। অনেক দিন ধরেই সে এখানে বাস করছে। অনেক মানুষ থাকে, তার কোনো অসুবিধা হয় না। যশোরের শিরীন ঢাকার পথে পথে ঘুরত। চার ভাই-বোন নিয়ে ছিল তাদের সংসার। শিশুটির বাবা ইলেকট্রিক কাজ করে সংসার চালাত। আয়ের টাকার বেশির ভাগ সে নেশা করে শেষ করে ফেলত। ফলে সংসারে অভাব সব সময় ছিল। বাবার আত্মহত্যার পর সংসারটি এলোমেলো হয়ে যায়। শিরীনের জায়গা হয় এতিমখানায়। এতিমখানায় ভালো লাগে না বলে সেখান থেকে পালিয়ে আসে তার মায়ের কাছে। কিন্তু মা আবার বিয়ে করে। সৎ বাবা মেনে নেয় না তাকে। তারপর জায়গা হয় এএসডি পরিচালিত ‘আনন্দ নিবাস’ আশ্রয়কেন্দ্রে। এখানে যখন আসে, তার অনেক মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
২০১২ সাল থেকে পথশিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করছে এএসডি। বর্তমানে ‘আনন্দ নিবাস’ নামের একটি মেয়েশিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র আছে প্রতিষ্ঠানটির। এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইউ কে এম ফারহানা সুলতানা ইত্তেফাককে বলেন, ৪০টি মেয়েশিশু আছে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে। ২০২৩ সালে তারা ঢাকা শহরের প্রবেশমুখ ও জনবহুল এলাকা সার্ভে করেন। তারা প্রতিটি মেয়েশিশুর যৌন হয়রানির তথ্য পান। তাছাড়াও মানসিক, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় এসব মেয়ে শিশু। সাত বছর থেকে ১৮ বছরের মেয়েরা পথে বাস করা ছেলেদেরসহ সব শ্রেণির মানুষ দ্বারা যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, পথে বাস করা ছেলেশিশুরা নানা রকমের নেশা করে। তাদের দেখে মেয়েশিশুরাও নেশায় আসক্ত হয়।
২০১৫ সালে সরকার পথশিশু ও ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের পুনর্বাসন শীর্ষক একটি প্রকল্প শুরু করে। প্রকল্প পরিচালক সাবেক উপসচিব ড. আবুল হোসেন ইত্তেফাককে বলেন—দারিদ্র্য, বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ, বহু বিবাহ, শারীরিক শাস্তি, মনোমালিন্য, নদী ভাঙনসহ নানা সামাজিক ও প্রাকৃতিক কারণে শিশুরা বাড়ি ছাড়ে। এসব শিশু যখন পথে স্বাধীনভাবে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন এক বেলা খেয়ে না খেয়ে তারা পথেই থাকতে চায়। সরকারের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক শিশু এ কারণেই পালিয়ে যায়। তাদের পুনর্বাসনের জন্য এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেখানে প্রান্তিক অবস্থা থেকে শহর পর্যন্ত শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তাদের জন্য কর্মমুখী ও স্বাভাবিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন আবুল হোসেন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ২০২৩ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ পরিচালিত ‘চাইল্ড সেক্সচুয়াল এ্যাবিউজ :এ কেস অন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ’ শীর্ষক গবেষণা করি। গবেষণায় দেখা যায় দরিদ্র শিশুরা প্রথমে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পরে জীবিকার জন্য অনেকে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তাদের পরিবার দরিদ্র হওয়ায় সন্তানদের খোঁজ রাখে না।