গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইউনিয়ন ব্যাংকের যে হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছিল, তার মালিককে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে। মোস্তাক ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাবটি ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর খোলা হয়েছিল ব্যাংকের বনানী শাখায়। ব্যাংকে থাকা নথিপত্রে ঢাকার যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যার জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে হিসাবটি খোলা হয়েছিল, তার সন্ধান পাওয়া গেছে।
হিসাবটি খোলা হয় মোহাম্মদ মুশতাক মিঞার নামে। তার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলমের ব্যক্তিগত সচিব ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আকিজ উদ্দিনের বাসায় রান্নার কাজ করেন মুশতাক মিঞা। তবে তার নামে যে এই ঋণ নেওয়া হয়েছে তা জানেন না খোদ মুশতাক মিঞা। তিনি বলেছেন, যখন তার নামে এই ঋণ নেওয়া হয়, তখন সেটা তিনি জানতেন না। কীভাবে টাকা পরিশোধ করবেন সেটাও বলতে পারেননি তিনি। স্থানীয় লোকজন জানান, ওই গ্রামের অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি ব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে, যার বিনিময়ে তারা প্রতি মাসে ভাতা পান।
জানা গেছে, বেসরকারি খাতের এই ব্যাংককে নির্বাচনের এক বছর আগে ওই হিসাবটি খুলে জমা করা হয় নগদ টাকা। হিসাবধারী প্রতিষ্ঠানকে ঋণও দেয় ব্যাংক। এরপর নির্বাচনের আগে সেই হিসাব থেকে নগদ উত্তোলন করা হয় ৭২ কোটি টাকা। ভোটের পরপরই রহস্যময় এই হিসাবে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়, আর এটি পুরোপুরি বন্ধ করা হয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ২০ আগস্ট।
ইউনিয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন এমন অনেককে ও তাদের পক্ষের ব্যক্তিদের তারা নির্বাচনের আগে এই হিসাব থেকে টাকা তুলতে দেখেছেন। ক্রিকেট থেকে চলচ্চিত্র তারকা, নবীন থেকে প্রবীণ প্রার্থীরাও ছিলেন এই তালিকায়। তারা মনে করেন, নির্বাচনের খরচ চালাতে তৎকালীন সরকারের পক্ষে এই টাকা বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাইফুল আলম। এ জন্য ইউনিয়ন ব্যাংকসহ তার মালিকানায় থাকা আরও ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নেওয়া হয়।
এই হিসাব খোলার সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হিসাবধারীর পরিচয় যাচাই না করে সেই সময় এস আলমের ব্যক্তিগত সচিব আকিজ উদ্দিন ও ব্যাংকের সাবেক এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নির্দেশে হিসাবটি খোলা হয়েছিল। এই হিসাবই পরে নির্বাচনের সময় অর্থ লেনদেনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউর নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ জমা ও উত্তোলন হলে ব্যাংকগুলোকে নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) ও যেকোনো হিসাবে হঠাৎ অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। তবে ইউনিয়ন ব্যাংক মোস্তাক ট্রেডার্সের হিসাবের ক্ষেত্রে ওই নিয়ম পরিপালন করেনি বলে জানা গেছে।
ইউনিয়ন ব্যাংকেরই দিলকুশা শাখা থেকে মোস্তাক ট্রেডার্সের নামে ২০২২ সালের ডিসেম্বর ও গত বছরের মার্চে মোট ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল, যার পুরোটাই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউনিয়ন ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ইউনিয়ন ব্যাংকসহ ৯টি ব্যাংককে এস আলমমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নানা আর্থিক অপরাধের অভিযোগ আসার পর আত্মগোপনে গেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীসহ ইউনিয়ন ব্যাংকের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা।
সূত্র: প্রথম আলো